হাদীস জালকরণের ভয়াবহ পরিণতি: ইসলামের দ্বিতীয় উৎস হাদীস। কুরআনের পরই হাদীসের মর্যাদা ও স্থান। হাদীস হলো রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এর কথা, কাজ, সর্মথন, সীরাত ও সিফাতের বিবরণ সমষ্টি। মুসলিম উম্মাহকে রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সর্বাবস্থায় এই হাদীস ও সুন্নাহকে দৃঢ়তার সাথে আকড়ে ধরার নির্দেশ দিয়েছেন। সুন্নাহর সাথে সুদৃঢ় বন্ধন পথভ্রষ্টতা থেকে মুক্তির একটি মাপকাঠি নির্ধারণ করেছেন।
হাদীস সংরক্ষণ ও পরবর্তী উম্মাহর নিকট বিতরণ নিয়ে উৎসাহব্যঞ্জক বহু হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
বিভিন্ন খোশখবর ও সুসংবাদ বর্ণিত হয়েছে সংরক্ষণকারী ও অপরের কাছে বিতরণকারীর জন্য।
তবে এ গুরুদায়িত্ব আদায়ে সর্বোচ্চ সতর্কতা ও সাবধানতা অবলম্বন অনস্বীকার্য।
সাহাবায়ে কেরাম রা. কে বারংবার এ সতর্কতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।
এ চেতনা তাঁদের মনমগজে প্রোথিত করে দিয়েছেন।
হাদীস জালকরণের ভয়াবহ পরিণতি কঠোর সতর্কীকরণের সাথে ইরশাদ হয়েছে
যেন ইচ্ছাকৃত কোনো ভুল বা স্বার্থান্বেষী কোনো মহল হাদীস জালকরণের ছিদ্রপথ খুঁজে না পায়। নিজেদের কথা, কাজকে হাদীস নামে বাজারজাতের সুযোগ না পায়।
কঠোর সতর্কীকরণের সাথে ইরশাদ হয়েছে,
مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ
“যে ব্যক্তি ইচ্ছাপূর্বক আমার উপর মিথ্যারোপ করবে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা খুঁজে নেয়।” (সহীহ বুখারী- ১০৭, সহীহ মুসলিম- ২)
হাদীসটি মুতাওয়াতির ও সহীহ।
সাহাবায়ে কেরাম রা. এর বৃহত্তর অংশ এ হাদীসটি বর্ণনা করেছেন। ইমাম বাযযার রহ. (২৯২হি.) তাঁর অমর হাদীস সংকলন ‘আলবাহরুয যাখখার’ (যেটি ‘মুসনাদুল বাযযার’ নামেই প্রসিদ্ধ)-এ উল্লেখ করেছেন যে, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে এ হাদীসটি ৪০জনের মতো পুরুষ সাহাবী রা. সরাসরি বর্ণনা করেছেন।’
আর কয়েকজন হাফেযুল হাদীস রহ. বলেছেন‘৬২জন সাহাবায়ে কেরাম রা. রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে হাদীসটি সরাসরি বর্ণনা করেছেন এবং তন্মধ্যে আশারা মুবাশশারাহ বিল জান্নাহ রা. (ঐ দশজন সাহাবায়ে কেরাম রা., যাঁদেরকে দুনিয়াতে থাকাবস্থায়ই জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে) আছেন।’
হাদীস জালকরণের ভয়াবহ পরিণতি
উপর্যুক্ত আলোচনা থেকে সহজেই উপলব্ধ যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে মিথ্যাচার কত নাযুক ও খতরনাক বিষয়।
ফলশ্রুতিতে তিনি বারবার এ থেকে হুঁশিয়ার করছেন।
উল্লিখিত হাদীসটির একাধিক ভাষ্য রয়েছে। তন্মধ্যে কোনো কোনো ভাষ্য আরেকটুু বিস্তারিত।
যেমন হযরত মুগীরাহ রা. নেম্নোক্ত শব্দে বর্ণনা করেন,
إِنَّ كَذِبًا عَلَيَّ لَيْسَ كَكَذِبٍ عَلَى أَحَدٍ، مَنْ كَذَبَ عَلَيَّ مُتَعَمِّدًا فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ.
“নিশ্চয়ই আমার উপর মিথ্যারোপ করা, অন্য কারো উপর মিথ্যারোপ করার মতো নয়।
যে আমার উপর স্বেচ্ছায় মিথ্যারোপ করবে, সে যেনো জাহান্নামে তার ঠিকানা নির্ধারণ করে নেয়।” (সহীহ বুখারী- ১২৯১, সহীহ মুসলিম- ৪)
হযরত আবু কাতাদা রা. এর বর্ণনাটি পূর্বেরটির তুলনায় আরও বিস্তারিত।
তাঁর বর্ণনামতে রাসূলে করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদীস বয়ান করার ক্ষেত্রে সাহাবীদের সর্বোচ্চ সতর্কতা ও কঠোর পরিণতির কথা বলেছেন। হযরত আবু কাতাদা রা. বলেন-
سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُولُ عَلَى هَذَا الْمِنْبَرِ: إِيَّاكُمْ وَكَثْرَةَ الْحَدِيثِ عَنِّي، فَمَنْ قَالَ عَلَيَّ فَلْيَقُلْ حَقًّا أَوْ صِدْقًا، وَمَنْ تَقَوَّلَ عَلَيَّ مَا لَمْ أَقُلْ، فَلْيَتَبَوَّأْ مَقْعَدَهُ مِنْ النَّارِ
“আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এ মিম্বারে দাড়িয়ে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, আমার সূত্রে অধিক হাদীস বর্ণনা থেকে বিরত থাকো।
সততা ও নিষ্ঠার সাথে হাদীস বর্ণনা করা যাবে
তবে কেউ বর্ণনা করতে চাইলে সততা ও নিষ্ঠার সাথে বর্ণনা করবে।
আর আমি যা বলিনি, তা যদি কেউ আমার নামে বর্ণনা করে, সে যেন জাহান্নামে তার ঠিকানা নির্ধারণ করে নেয়।” (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা- ২৬৭৬৮, সুনানে ইবনে মাজাহ- ৩৫)
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে বানোয়াট কথা ও মিথ্যাচারের কী ভয়াবহ পরিণতি- আশা করি উল্লিখিত হাদীসসমূহ থেকে সুস্পষ্ট।
স্মর্তব্য: রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামে হাদীস জালকরণ যেরূপ জঘণ্য ও ঘৃণিত কাজ, অনুরূপ জাল ও বানোয়াট হাদীস তাঁর নামে প্রচার করাও জঘণ্যতম অপরাধ।
মিথ্যা ও অসত্যের অবগতির পরও নবীজীর নামে জাল হাদীস বর্ণনাকারী ও প্রচারকারী ব্যক্তি মিথ্যুক বলে বিবেচিত হবে। নবীজী এমন ব্যক্তিকে মিথ্যুক সাব্যস্ত করে বলেন,
مَنْ حَدَّثَ عَنِّي حَدِيثًا وَهُوَ يَرَى أَنَّهُ كَذِبٌ، فَهُوَ أَحَدُ الْكَاذِبَيْنِ.
‘জানা সত্ত্বেও যে আমার নামে মিথ্যা হাদীস প্রচার করে, সে মিথ্যুকদের একজন!’ (সহীহ মুসলিম (মুকাদ্দিমা), সুনানে ইবনে মাজাহ- ৩৮)
[মাসিক মুঈনুল ইসলাম। সফর- 1441। অক্টোবর- 2019]
আরো পড়ুন:
- একজন দুনিয়া বিমুখ আলেম
- হাদীস বর্ণনায় সাহাবায়ে কেরামের অভূতপূর্ব সতর্কতা
- পর্নোগ্রাফির মরণকামড় থেকে মুক্তির উপায়
- জ্ঞানার্জনে দিগ দিগন্তে গমনের ফযীলত ও হাদীসের আলো ।