“রাসুল (সাঃ)গায়েব জানতেন“- এ আক্বীদা পোষণ করার বিধান

“রাসুল (সাঃ)গায়েব জানতেন“- এ আক্বীদা পোষণ করার বিধান মুফতি খাইরুল ইসলাম

বর্তমান সমাজে একটি প্রচলিত ধারণা হচ্ছে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েবের খবর জানতেন। গায়েব বলতে সাধারণত ভবিষ্যতের খবর এবং চোখের আড়ালে ঘটে যাওয়া ঘটনার সংবাদকে বুঝায়। তারা দাবি করে যে, রাসূল (সাঃ) এর “গায়েব” তথা “অদৃশ্যের জ্ঞান” অর্জনের নিজস্ব ক্ষমতা ছিল। এটি এমন একটি কুফরী বিশ্বাস যার কারণে মানুষ কাফির হয়ে যায়। কেননা গায়েবের খবর একমাত্র আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা জানেন।

“রাসুল (সাঃ)গায়েব জানতেন“- এ আক্বীদা পোষণ করার বিধান

আল্লাহ ছাড়া আর কারো পক্ষে নিজস্ব ক্ষমতায় অদৃশ্যের জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব নয়।

 

গায়েব এর পরিচয়:

“গায়েব “-এর আভিধানিক অর্থ হলো কোন জিনিষ গোপন থাকা। যে জিনিস আমাদের থেকে গোপন রয়েছে তাকেও গায়েব বলা হয়।
আর শরীয়তের পরিভাষায় “গায়েব “ বলা হয় প্রত্যেক ঐ জিনিষকে যা বান্দার থেকে গোপন থাকে। ইবনে কাসীর,সুদ্দী মুফাসসিরীনের কেরামের উদ্ধৃতি দিয়ে ইবনে আব্বাস রা.ইবনে মাসউদ রা.প্রমুখ সাহাবায়ে কেরাম থেকে বর্ণানা করেনঃ
“গায়েব “- হল ঐ জিনিস,যা বান্দা থেকে গোপন রয়েছে। যেমন জান্নাত-জাহান্নামের অবস্থা সমুহ এবং কুরআনে বর্ণিত বিষয়াবলী। তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/১৪.

আইম্মায়ে আহনাফের প্রসিদ্ধ তাফসীর গ্রন্থ مدارک এ বলা হয়েছে,
والغیب : هو مالم یقم علیه دلیل ولا اطلع علیه مخلوق
অর্থাৎ এ জিনিসকে গায়েব বলা হয়, যার উপর কোন প্রমাণ বিদ্যমান নেই এবং কোন মাখলুক সে বিষয়ে অবগত নয়।
নবী করীম সা.-এর গায়েব জানা সম্পর্কে সারকথাঃ
নবী করীম সা. এর গায়েব জানা সম্পর্কে আহলুস্ সুন্নাত ওয়াল জামাতের আকিদা বিশ্বাস হলো নবী সা.কে তার শান মত আল্লাহ তাআলার সত্তা ও সিফাত সম্পর্কে, অতীত ও ভবিষ্যতের অসংখ্য ঘটনার মধ্যে বারযাখ, কবরের অবস্থা, হাশরের ময়দানের চিত্র, জান্নাত-জাহান্নামের পরিস্থিতি ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে এমন জ্ঞান প্রদান করা হয়েছে যা কোন নবী কিংবা কোন নৈকট্য লাভকারী ফেরেশতাকেও দেওয়া হয়নি।

যার আন্দাজ একমাত্র আল্লাহ তাআলাই করতে পারেন। তবে সেটা আল্লাহ তাআলার সর্ব বিষয়ের সামগ্রিক ও পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান (علم محیط) এর সামনে কিছুই নয়।
সার্বিকভাবে ইলমে গায়েব আল্লাহ তায়ালারই বৈশিষ্ট্য ও গুণ, যা আল্লাহ ছাড়া সৃষ্টির মধ্যে আর কারো জন্য হতে পারে না। এমনকি স্বয়ং নবী কারীম সা.ও এ ধরনের গুণে গুণান্বিত ছিলেন না। যদিও নবী করীম সা.-এর আল্লাহ প্রদত্ত ইলম ও জ্ঞান সমস্ত সৃষ্টির মধ্যে সবার ঊর্ধ্বে। তাই আলিমুল গায়েব কেবল মাত্র আল্লাহ তায়ালাই। এই আক্বীদা পোষণ করা মুসলমান হওয়ার পূর্বশর্ত। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো জন্য এমনকি নবী করীম সা.এর ব্যাপারে সরাসরি আলিমুল গায়েব আক্বীদা পোষণকারী মুসলমান হতে পারে না। এ ধরণের আক্বীদা সম্পূর্ণভাবে ইসলামী আক্বীদার পরিপন্থী।

“আহলুস সুন্নাত ওয়াল জামা’আতের দলীল “-“রাসুল (সাঃ)গায়েব জানতেন“- এ আক্বীদা পোষণ করার বিধান

قُل لَّا يَعْلَمُ مَن فِي السَّمَاوَاتِ وَالْأَرْضِ الْغَيْبَ إِلَّا اللَّهُ وَمَا يَشْعُرُونَ أَيَّانَ يُبْعَثُونَ [النمل:65]،

মহান আল্লাহ বলেনঃ “বলুন, আল্লাহ ছাড়া আকাশ মণ্ডলী ও পৃথিবীতে কেউ অদৃশ্যের জ্ঞান রাখে না এবং তারা জানে না কখন তারা পুনরুত্থিত হবে”। [সূরা নামল, আয়াত ৬৫]

وَعِندَهُ مَفَاتِحُ الْغَيْبِ لاَ يَعْلَمُهَا إِلاَّ هُوَ وَيَعْلَمُ مَا فِي الْبَرِّ وَالْبَحْرِ وَمَا تَسْقُطُ مِن وَرَقَةٍ إِلاَّ يَعْلَمُهَا وَلاَ حَبَّةٍ فِي ظُلُمَاتِ الأَرْضِ وَلاَ رَطْبٍ وَلاَ يَابِسٍ إِلاَّ فِي كِتَابٍ مُّبِينٍ [الأنعام:59]،

মহান আল্লাহ আরো বলেনঃ “আর তাঁরই কাছে অদৃশ্যের চাবিকাঠি রয়েছে। কেউ তা জানে না তিনি ছাড়া। আর তিনি জানেন যা আছে স্থলদেশে ও সমুদ্রে। আর গাছের এমন একটি পাতাও পড়ে না যা তিনি জানেন না আর কোন শস্য কণা মাটির অন্ধকারে পতিত হয় না এবং কোন আর্দ্র ও শুষ্ক দ্রব্য পতিত হয় না। সমস্ত বস্তুই সুস্পষ্ট কিতাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে”। [সূরা আনআম, আয়াত ৫৯]

قُل لاَّ أَمْلِكُ لِنَفْسِي نَفْعًا وَلاَ ضَرًّا إِلاَّ مَا شَاء اللّهُ وَلَوْ كُنتُ أَعْلَمُ الْغَيْبَ لاَسْتَكْثَرْتُ مِنَ الْخَيْرِ وَمَا مَسَّنِيَ السُّوءُ [الأعراف:188]

আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে আদেশ করে বলেনঃ “বলুন, আল্লাহ যা ইচ্ছা করেন তা ছাড়া নিজের লাভ ক্ষতির কোন অধিকার আমার নেই৷ আর যদি আমি গায়েবের খবর জানতাম তাহলে অনেক কল্যাণ লাভ করতে পারতাম এবং কখনো আমার কোন ক্ষতি হতো না।”৷ [সূরা আরাফ ১৮৮]

আল্লাহ তায়ালা বলেনঃ “বলুন, আমি তোমাদেরকে বলি না যে, আমার কাছে আল্লাহর ভান্ডার রয়েছে। আর আমি অদৃশ্যের কোন জ্ঞানও রাখি না। এবং আমি তোমাদেরকে এ কথাও বলি না যে, আমি ফেরেশতা। আমি তো শুধু ঐ ওহীর অনুসরণ করি, যা আমার কাছে আসে”। [সূরা আন’আম, আয়াত ৫০]
.

عَنْ مَسْرُوْقٍ قَالَ قُلْتُ لِعَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا يَا أُمَّتَاهْ هَلْ رَأَى مُحَمَّدٌ صلى الله عليه وسلم رَبَّهُ فَقَالَتْ لَقَدْ قَفَّ شَعَرِيْ مِمَّا قُلْتَ أَيْنَ أَنْتَ مِنْ ثَلَاثٍ مَنْ حَدَّثَكَهُنَّ فَقَدْ كَذَبَ مَنْ حَدَّثَكَ أَنَّ مُحَمَّدًا صلى الله عليه وسلم رَأَى رَبَّهُ فَقَدْ كَذَبَ ثُمَّ قَرَأَتْ {لَا تُدْرِكُهُ الْأَبْصَارُ زوَهُوَ يُدْرِكُ الْأَبْصَارَ جوَهُوَ اللَّطِيْفُ الْخَبِيْرُوَمَا كَانَ لِبَشَرٍ أَنْ يُّكَلِّمَهُ اللهُ إِلَّا وَحْيًا أَوْ مِنْ وَّرَآءِ حِجَابٍ} وَمَنْ حَدَّثَكَ أَنَّهُ يَعْلَمُ مَا فِيْ غَدٍ فَقَدْ كَذَبَ ثُمَّ قَرَأَتْ {وَمَا تَدْرِيْ نَفْسٌ مَّاذَا تَكْسِبُ غَدًا} وَمَنْ حَدَّثَكَ أَنَّهُ كَتَمَ فَقَدْ كَذَبَ ثُمَّ قَرَأَتْ {يَٰٓأَيُّهَا الرَّسُوْلُ بَلِّغْ مَآ أُنْزِلَ إِلَيْكَ مِنْ رَّبِّكَ} الْآيَةَ وَلَكِنَّهُ رَأَى جِبْرِيْلَ عَلَيْهِ السَّلَام فِيْ صُوْرَتِهِ مَرَّتَيْنِ.

আয়িশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ যে ব্যক্তি তোমাকে বলে মুহাম্মাদ স্বীয় প্রতিপালককে দেখেছে, অবশ্যই সে মিথ্যা বলল। কেননা তিনি (আল্লাহ) বলছেন, চক্ষুরাজি কখনো তাকে দেখতে পায় না। আর যে ব্যক্তি তোমাকে বলে মুহাম্মাদ গায়েব জানেন, অবশ্য সেও মিথ্যা বলল। কেননা তিনি (আল্লাহ) বলেন, গায়েব জানেন একমাত্র আল্লাহ। [সহীহ বুখারী,হাদিস নং ৪৮৫৫ ]
.
ইবনু উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু সূত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ গায়েবের চাবিকাঠি পাঁচটি, যা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই জানে না। মাতৃগর্ভে কি গুপ্ত রয়েছে তা জানেন একমাত্র আল্লাহ এবং আগামীকাল কি সংঘটিত হবে তাও জানেন একমাত্র আল্লাহ এবং বৃষ্টিপাত কখন হবে তাও একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই জানে না এবং কে কোন ভূমিতে মারা যাবে তা আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই জানে না এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কেউই জানে না কিয়ামত কখন সংঘটিত হবে। [সহীহ বুখারী, হাদিস নং ৬৮৭৫ ]

আয়িশা (রাঃ) এর প্রতি মিথ্যা অপবাদের ঘটনাটি প্রমাণ করে যে, রাসূল (সাঃ) গায়েবের খবর জানতেন না। যদি গায়েবের খবর জানতেন তাহলে যখন আয়িশা (রাঃ) এর উপর মিথ্যা অপবাদ দেওয়া হয়েছিল তখনই তিনি বলে দিতেন যে, এটি মিথ্যা অপবাদ ছাড়া আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু তিনি কিছুই বলতে পারেন নি; বরং ওহী অবতীর্ণ হওয়ার পর মিথ্যা অপবাদের অবসান ঘটেছে। [ফাতহুল বারী, ৮/৫৭৪, হাদিস নং ৪৭৫০]
.
ফকীহগণ বলেনঃ যদি কোন ব্যক্তি আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সাঃ)-কে সাক্ষী রেখে বিবাহ করে তবে তাদের বিবাহ মোটেই হবে না এবং ঐ ব্যক্তি কাফির হয়ে যাবে। কেননা সে এই বিশ্বাস করেছে যে, রাসূল (সাঃ) গায়েব জানেন। [শাইখ সুলতান মা’সুমী হানাফী, হুকমুল্লাহিল ওয়াহিদ আস সামাদ, ৯৬ পৃষ্ঠা; শাইখ শামসুদ্দীন আফগানী, জুহুদূল উলামা আল হানাফিয়্যাহ ফি ইবত্বালি আক্বায়িদি আল কুবুরিয়্যা, ২/৯২৮-৯২৯]

উলামায়ে আহনাফ ঐকমত পোষণ করেন, যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে গায়েব জান্তা বলে বিশ্বাস করে, সে ব্যক্তি মুশরিক অথবা কাফির বলে গণ্য হবে। [শাইখ শামসুদ্দীন আফগানী, জুহুদূল উলামা আল হানাফিয়্যা, ২/৯২৫]

পবিত্র কুরআন, সহীহ হাদিস এবং উলামায়ে কেরামের বাণী থেকে বুঝা যায় যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম গায়েবের খবর জানতেন না। সুতরাং যে ব্যক্তি ধারণা করবে যে, রাসূল (সাঃ) অথবা পীর মাশায়েখ ওলী আউলিয়া গণক যাদুকর গায়েবের খবর জানেন, তাহলে সে কাফির হয়ে যাবে।

“ তাফসীরুল খাযিন ৩/৩৫২. আহকামুল কুরআন ৩/৪৪. শরহুল ফিকহিল আকবর ১৫১. ফতওয়ায়ে রশীদিয়া ৬১.খায়রুল ফাতওয়া ১/২০৮.ফতোয়ায়ে মাহমুদিয়া ১০/২০.

লেখকের আরো লেখা পড়ুন

Related Posts

No Responses

Add Comment

You cannot copy content of this page